প্রেমিকার সর্দি
প্রেমিকার সর্দি
তৌহিদুল ইসলাম
মান্টোর 'প্রেম আমার প্রেম' পড়ে উপন্যাসের নায়ক সাইদের প্রতি আমার পরাণের গহীনে ছিনছিনে একটা ব্যথা অনুভব হয়েছিলো। সাইদের জীবনে প্রেমের ধরণটা ছিলো মেরু অঞ্চলের দিনের মতো, যেন আসতেই চাইতো না। তার উপর বেচারা সাইদের সবসময় সর্দি লেগেই থাকতো। বেলাশেষে সাইদের সর্দি পরিপক্কতা লাভ করে নিউমোনিয়ায় রূপান্তরিত হয়ে; সাইদকে নিয়ে যায় হাসপাতালের শাদা বিছানায়। শাদা বিছানা যদিও তার জীবনে কোনো কাল ছিলো না বরঞ্চ তার জীবনে নিয়ে আসে প্রভাকরদীপ্ত বাসন্তিক প্রেম। এমন প্রেম কয়জনের ললাটেই বা জোটে! মানুষের জীবনে প্রেমের আগমন হয়তো নেহাত উপলক্ষ্য মাত্র।কার জীবনে প্রেম কিভাবে আসে, তা হয়তো বুঝে উঠাই মুশকিল। কেউ প্রেমের জন্য কাঠখড় পোড়াতে পোড়াতে এতই মগ্ন থাকে, দিনশেষে দাহ্যিত ভস্মাংশ নিয়ে কুটিরে ফিরতে ব্যর্থ হয়। অনেকে আবার কাঠখড় পোড়ানো ছাড়াই প্রেম নামক মহাসমুদ্রের উত্তাল সমুদ্রের নাবিক হয়ে যায়। ব্যর্থতা আর সফলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছিনা। ব্যর্থতা,সফলতা নিছক আক্ষরিক কিংবা আপেক্ষিক। তবে এটা চূড়ান্ত মহাসত্য মানুষ মাত্রই প্রেমাকাঙ্ক্ষী, জাগতিক কিংবা অাধ্যাত্মিক। সব প্রেমেরই একটা লক্ষ্য থাকে, লক্ষ্য বললে ভুল হবে; স্বার্থ বলা অতীব জরুরি। একধরণের মানুষ আছে যারা একান্তে প্রেমসন্ধিৎসু হয়ে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু বিধিবাম প্রেমের ধারে কাছে ঘেঁষতে না পেরে নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে অবশেষে প্রেমবিরোধি প্রচারণায় নিজেকে লিপ্ত করে। শোনে মনে হয় এরা যেন জগতের কালপুরুষ, প্রেম এদের কাছে হাসি তামাশার বিষয়। দুনিয়ার এমন কোনো মহামানব নেই কিংবা ছিলো না যার জীবনে প্রেমের অাবির্ভাব ঘটেনি। উপরিউক্ত দুই শ্রেণির মধ্যে প্রথম শ্রেণির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আমাদের নিলকান্ত। নিলকান্তের অবশ্য একটা ভালো নাম আছে যেটাকে আমরা পিতৃপ্রদত্ত নাম হিসেবে জানি। নিলকান্তের নাম রাখার পেছনে রয়েছে বিরাট এক ঘটনা। যাইহোক সব চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে নিলকান্তের নাম সৈয়্যদ তুহিন আহমেদ এ স্থির হয়। এ নামকরণে তার পিতা সৈয়্যদ তাহের আহমেদের হস্তক্ষেপেই বেশি লক্ষ্য করা যায়। এ নিয়ে মাতা নিহারুন্নিসার একটা আক্ষেপ থেকেই যায়। সবার অন্তরালে চুপিসারে তুহিন আহমেদের জননী তুহিনকে নিলকান্ত বলে সম্বোধন করতো। নিলকান্ত নামটি সময়ের বিবর্তনের সাথে পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য ছাড়িয়ে জননীর প্যাটেন্টকৃত নামে সমাদৃত হয়। নিলকান্ত যখন উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র ছিলো তখন তার ভিতরে এক ধরণের ভালো লাগা কাজ করা শুরু করে। সে ভালো লাগাটাকে হয়তো প্রেমের প্রথম ধাপ হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। মহাবিদ্যালয়ের সুশ্রী তনয়াদের দেখলে নিলকান্তের বুকটা ক্যামোন ধড়পড় শুরু করে দিতো।এই ধড়পড়ানির মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা নিলকান্তের জানা ছিলো না। তার বন্ধুরা যখন প্রেয়সীর হাত ধরে বিকেল বেলায় নদীর তীরে হাঁটতো, সূর্যাস্ত দেখতো তখন বন্ধুদের ক্যামোন লাগতো ; তা জানার খুব ইচ্ছে হতো। কিন্তু, চাপা স্বভাবের হওয়ায় তার পক্ষে তা আর জানা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তবে প্রেমের স্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকার কারণে নিলকান্তকে বন্ধুদের টিপ্পনী কিংবা কটু কথা শুনতে হতো। কথাগুলো তার প্রেমবঞ্চিত কোমল হৃদয়ে করুণ আঘাত হানতো; মনে হতো দাঁতের তলায় জিহ্বা পড়ার মতো অবস্থা। এইসব অপমানের দায়ভাগ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে নিলকান্ত দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয় যেভাবেই হোক অল্প কিছুদিনের মধ্যে একজন প্রেয়সী জুটিয়ে নিবে। কে হবে তার স্বনির্বাচিত প্রেমিকা এ ভাবনাতেই কয়েকদিন পার করে দেয়। কিছুতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। তবে নিলীমার প্রতি তার একটু দূর্বলতা কাজ করতো যদিও এটাকে প্রেম বলা যায় না। এটা সত্য যে দূর্বলতা থেকেই প্রেমের সূচনা। নিলকান্তের ক্ষেত্রেও উল্টো কোনো ব্যাপার ঘটেনি। নিলীমার প্রেমেই অবশেষে নিলকান্ত খাবি খেতে শুরু করে। নিলীমা দেখতে যদিও আট-দশজন প্রেমিকার মতো ফর্সা নামক সুন্দরি ছিলো না। গাত্ররং যদিও শ্যামবর্ণের ছিলো, সুস্বাস্থ্যবতী ছিলো বিধায় দেবি স্বরস্বতীর প্রতিকৃতি মনে হতো। মোট কথায় সৌন্দর্যের নান্দনিকতা নিলীমার প্রতিটি অঙ্গ থেকে বিচ্ছুরিত হতো। স্বল্পভাষিণী, মিষ্টিহাসির অধিকারিণী নিলীমার পাণে তাকালে নিলকান্ত একধরণের ঘোরে সাঁতার কাটতো। নিলকান্ত যখনই সুযোগ পেত নিলীমার দিকে অবুঝ বালকের মতো তাকিয়েই থাকতো। শ্রেণিকক্ষ,খেলার মাঠ কিংবা পথের দ্বারে অযাচিতভাবে নিলকান্তের দৃষ্টি নিলীমাকে তাড়িয়ে ফেরতো। ব্যাপারটি নিলীমার কাছে খুব বেশি খারাপ লাগতো না। নারী হৃদয় মাত্রই পুরুষের প্রেমাকাঙ্ক্ষী। নিলীমার প্রত্যাশা ছিলো একদিন নিলকান্ত মুখ ফুটে হৃদয়ের সকল আকুতি প্রকাশ করে দিবে। নিলীমা সে প্রতীক্ষায় প্রহর গুনতো। কিন্তু, নিলকান্তের তা আর বলা হয়ে উঠে না। নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্র কেবল বস্তুর মাঝে কাজ করে ব্যাপারটা এমন নয়। মানব হৃদয়েও নিউটনের তৃতীয় সূত্রের কার্যকরী ভূমিকা রয়েছে। এদিকে নিলকান্তের একতরফা প্রেম নিলীমার প্রতি যতই বাড়তে থাকে, নিলকান্তের জন্য নিলীমা ততই দূর্বল হয়ে পড়ে। সমস্যা হলো কেউই মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। দুজনেরই ইচ্ছে হতো খুব কাছাকাছি আসতে কিন্তু কাঁচে মোড়ানো শঙ্কার কারণে তা আর হয়ে উঠতো না। এভাবে দেখতে দেখতে কয়েকটি মাস কেটে যায়। তবুও নবজাতক প্রেমের বাহ্যিক প্রকাশ হয় না। শীত গড়িয়ে বসন্ত আসে। নিলকান্ত তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো যে করেই হোক অব্যক্ত কথাগুলো নিলীমাকে শুনিয়ে দিবে। একদিন ক্লাস শেষ করে পথের দ্বার দিয়ে দুজনে হেঁটে যাচ্ছে। বসন্তের নব বাতাস নবপ্রেমিকদ্বয়ের হৃদয়ে উতলা পাল তুলে দেয়। নিলকান্ত মুখ ফসকে নিলীমাকে বলেই ফেললো, নিলীমা তোমার সাথে কিছু কথা আছে। - আমার সাথে! বিস্ময়ে উত্তর দেয় নিলীমা। - হ্যাঁ,তোমার সাথে। - তো বলে ফেলো। - নাহ্, আজ না। আগামীকাল বলবো। - ঠিক আছে। করুণ এক সুখের অনু্ভূতি নিয়ে দুজনেই বাড়ি ফেরে। পড়ন্ত বিকেলের ঘটনাটি কি কল্পনা, নাকি সত্যি! এ নিয়ে দুজনেরই ভাবনা। নিলীমা যেন সেদিন চাঁদ হাতে পেয়েছিল। কোনো কিছুতেই তার মন বসছে না। কখন যে সকাল হবে, কখন প্রিয় মানুষটি এসে বলে দিবে ভালোবাসা নামক মহাকাব্যের প্রথম পঙক্তিটি। বসন্তের মৃদু ছান্দসিক বাতাস নিলীমার দেহে দোলা দিয়ে যায়। নিলকান্তের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। পরদিন সকালে নিলীমা নিজের মাঝে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করে। চোখ আর নাক দিয়ে পানি পড়ছে, বুঝতে অসুবিধে হয়নি বসন্তের কোমল বাতাস সর্দির সুসংবাদ নিয়ে এসেছে। তবে এর চেয়ে বড় কথা হলো আজ তার ভালোবাসার মানুষটির সাথে বোঝাপড়া হবে। আস্তে আস্তে নিলীমা নিজেকে সাজিয়ে নেয় অপরূপ সাজে। মাথায় গন্ধরাজ ফুলের খোঁপা, পরনে নিল শাড়ি; দেখে মনে হয় প্যান্ডোরা আজ হার মানবে নিলীমার সৌন্দর্যের কাছে। নিলকান্তও সেদিন নিল পাঞ্জাবি পরে এসেছিলো প্রেয়সীকে মনের কথা খুলে বলতে। দুজন যখন সামনাসামনি দাঁড়ালো মনে হয়েছিল নীলকরদের কুঠিতে জমানো নিলের স্তূপ। দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু কিভাবে শুরু করবে তা কেউই বুঝে উঠতে পারলো না। এভাবে কয়েক মিনিট পার হয়ে যায়। নিলকান্ত কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় নিলীমা বিকট শব্দে হাঁচি দিয়ে উঠে; নিলকান্তের জন্য এতদিনের জমানো ভালোবাসা, মান-অভিমান সবকিছুই নিলকান্তের মুখে, পাঞ্জাবিতে ঝেড়ে ফেলে। নিলকান্ত কিছু বুঝে উঠার আগেই নিলীমা লজ্জায় স্থান ত্যাগ করে। অবুঝ বালকের মতো নিলকান্ত প্রেয়সীর চলে যাওয়া অবলোকন করে।
চৌধুরিহাট ২৫.১১.১৮
Comments